মানহানি মামলার কেস কিভাবে করতে হয় , কি কি আইন আছে? পুলিশ কেস করবেন না কি নিয়মে এগুবেন ?
মানুষ! মান আর হুঁশ এই দুই মিলে এক নাম। কিন্তু এই মানুষেরই যখন হুঁশ থাকে না, তখন আমরা তাঁকে বেহুঁশ বলি । মান আছে অথচ আমরা যখন তাঁকে মান দিই না, তখন তাকে অসম্মান করা হয়। আর মানী হোক বা না হোক ভদ্রলোক হলে আরেক ভদ্রলোককে মান দিতে হবে, এটাই বাস্তব কথা। আপনি যদি মান সম্মান ওয়ালা লোককে সম্মান প্রদর্শন না করেন , হতে পারে সেটা আপনার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার কিন্ত তাতে হইতে বিপরীত হতেও পারে । কারন যার মান সম্মান আছে সেটাও তার একান্ত ব্যক্তিগত, যা একপ্রকার সম্পদের মতো। যেমন দেখবেন কোনও কোম্পানি বিক্রি করার সময় সেই কোম্পানির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হিসেব করার সময় ‘গুড উইল’ও হিসেব করা হয় একটি টাকার অংকে। আপনি কারো মান সম্মান যখন নষ্ট করতে চাইবেন, তখন সেটি ওই ব্যক্তির মানসিক ক্ষতির পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর আপনি যখন কারো মান সম্মান নষ্ট করতে চান বা করেন, তখন আইনের ভাষায় সেটিকে বলে মানহানি। মানহানি এমন একটি অপরাধ যার বিরুদ্ধে ফৌজদারি এবং দেওয়ানী উভয় প্রকারের প্রতিকার পাওয়া যায়।
আগে মানহানি সরাসরি বা অফলাইনে হলেও বর্তমানে অনলাইনেও মানহানি হয়ে থাকে। তাই সাইবার আইনেও মানহানিকে অপরাধ হিসেবে ধরা হয়। আইপিসি ধারা ৪৯৯তে মানহানি সম্বন্ধে বলা হয়েছে।
এই দণ্ডবিধি অনুসারে, একজন ব্যক্তি যদি অন্য কোনও ব্যক্তির সুনাম বা মান বা খ্যাতি যাই বলি না কেন, যদি সেটি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভ হয়ে বা ওই ব্যক্তির সুনাম/মান নষ্ট হবে জেনে শুনে শব্দের দ্বারা বা চিহ্ন ব্যবহারের মাধ্যমে বা কোনও প্রকার প্রতীক যা দৃশ্যমান তার মাধ্যমে নিন্দা প্রকাশ পায়, তাহলে ধরে নেওয়া হবে যে উক্ত শব্দ/চিহ্ন/প্রতীক দ্বারা ওই ব্যক্তির মানহানি করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে আপনি হয়ত ভাবছেন যে, এভাবে হিসেব করলে তো চোরকেও চোর বলা যাবে না, কারণ এতে তার মানহানি হবে। কিন্তু, ব্যাপারটি সেটি নয়। আপনি যেমন কারো সুনাম নষ্ট করার জন্য কোনও নিন্দা প্রকাশ করতে পারেন না, তেমনি আপনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুনাম নষ্ট হলেও, মানহানি হলেও সত্য কথা বলতে পারবেন। সত্যি বলতে আপনার কোনও বাঁধা নেই, সেটি যেকোনো পর্যায়েই হোক না কেন। যেমন আপনি যদি জনগণের কল্যাণে, সরকারী কর্মচারীর সরকারী কোনও কাজে তার আচরণ সম্বন্ধে সরল বিশ্বাসে কিছু বললে, আদালতের কার্যবিবরণী প্রতিবেদন প্রকাশ করলে, জনসমস্যা বিষয়ে বা কোনও ব্যক্তির আচরণ সম্বন্ধে সরল বিশ্বাসে কিছু বললে, গণ-অনুষ্ঠানের অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মন্তব্য করলে, সরল বিশ্বাসে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ দায়ের করলে, আদালতের সিদ্ধান্তে মামলার দোষ, গুন নিয়ে সরল বিশ্বাসে কথা বললে সেটি মানহানি হবে না। মানহানি হতে হলে অবশ্যই আপনাকে মিথ্যা কিছু বলতে হবে, যদি তা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়। সরল বিশ্বাসে সত্য কথা বললে সেটি কোনও মতেই মানহানি হচ্ছে না। যে চুরি করেনি, তাকে আপনি চোর বললে সেটা ওই ব্যক্তির জন্য মানহানি হবে।
মানহানি মামলা কে করবে?
এক্ষেত্রে আপনার মানহানি হলে আপনি মামলা করতে পারবেন, অথবা আপনার মৃত বাবা, মা বা কোনও আত্মীয়ের যদি মানহানি হয়ে থাকে তাহলেও আপনি মামলা করতে পারবেন। এছাড়া, অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা মানসিক বা শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী কারো মানহানি করা হলে তার পক্ষ থেকে তার অভিভাবক মানহানির মামলা করতে পারবে। অর্থাৎ সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা তার পক্ষে অভিভাবক মানহানির মামলা করতে পারবেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৮ ধারা অনুসারে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ছাড়াও নিমোক্ত ব্যক্তিগণ এই মামলা করতে পারবে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ছাড়া মানহানির মামলা করলে আদালত তা আমলে নেবেন না। যদি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি মহিলা হয় সেক্ষেত্রে নিচের শর্তসাপেক্ষে আদালতের অনুমতি নিয়ে অন্য কেউ মামলাটি করতে পারেন-
(১) উক্ত মহিলা দেশের রীতিনীতি ও প্রথানুসারে জনসমক্ষে হাজির হতে বাধ্য করা উচিত হবে না।
(২) উক্ত মহিলার বয়স ১৮ বছরের নীচে অথবা উন্মাদ অথবা আহাম্মক বা পীড়া বা অক্ষমতার কারণে নালিশ করতে অসমর্থ হন।
মানহানির জন্য মামলা কীভাবে দায়ের করবেন?
মানহানি একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত অধিকার লঙ্ঘন করা হিসেবে ধরা হয়। যে কোনও মানহানির দেওয়ানি প্রতিকার হতে পারে, যেখানে অভিযোগকারীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বা ফৌজদারি শাস্তি যেখানে অভিযুক্তকে ২ বছর পর্যন্ত সাধারণ কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হতে পারে।
মানহানির অভিযোগ দায়ের করা যেতে পারে মেজিস্ট্রেটের কাছে। যিনি একজন পুলিশ অফিসারকে তদন্ত করার নির্দেশ দেবেন এবং তৎপরবর্তী ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে। এই দেওয়ানি মামলায়, অবশ্যই অভিযোগকারীকে সিপিসি ধারা ১৯ এর আওতায় থাকা দেওয়ানী আদালতে অভিযোগ দাখিল করতে হবে।
মানহানি করলে কোন আইনে কি শাস্তির বিধান রয়েছে?
মানহানি সবসময় যে অফলাইনে হবে তা কিন্তু নয়। বরং, বর্তমানে অনলাইনে আমরা অফলাইনের চেয়ে অনেক বেশী সময় কাটাই। ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ইত্যাদিতে আমরা এখন প্রচুর সময় কাটাচ্ছি, এমনকি কোনো পত্রিকা পড়তে হলেও আমাদেরকে এখন অনলাইনেই ক্লিক করতে হয়। এই অনলাইনেও কিন্তু মানুষ একজন আরেকজনের মানহানি ঘটাতে পারে। তাই, ভারতীয় দণ্ড সংহিতার ধারা ৫০০-র অন্তর্গত মানহানির জন্য ২ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়ই হতে পারে। এক্ষেত্রে কেউ যদি একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি করে তাহলে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়ই পেতে পারে। আর এটি জামিন যোগ্য অপরাধ।
কোন মন্তব্য নেই: